Monday, March 2, 2020

শ্রীল মাধবেন্দ্ৰ পুরীপাদ
(তিরোভাব)
হরে কৃষ্ণ, আগামী ০৬/০৩/২০২০ ইং রোজ - শুক্রবার পরমহংস শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদেরর শুভ তিরোভাব তিথি বিরহ মহামহোৎসব।

‘’শ্রীমান লক্ষ্মীপতিস্তস্য শিষ্যো ভক্তিরসাশ্রয়ঃ।
তস্য শিষ্য মাধবেন্দ্রো যদ্ধর্ম্মোহয়ং প্রবর্ত্তিতঃ।।‘’

শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ কলিকালে ব্রহ্ম সম্প্রদায়ের বা মধ্বাচার্য্য সম্প্রদায়ভুক্ত গুরু। শ্রীলক্ষ্মীপতির শিষ্য শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদ। শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদের শিষ্য মধ্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গুরুদেব ঈশ্বর পুরী, অদ্বৈত আচার্য, শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু, পরমানন্দ পুরী, ব্রহ্মানন্দ পুরী, রঙ্গপুরী, পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি রঘুপতি উপাধ্যায় প্রমূখ বিখ্যাত ছিলেন।

শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদের অনুশিষ্য শ্রীচৈতন্যদেব। শ্রীমধ্বসম্প্রদায়ে ইঁহার পূর্বে প্রেমভক্তির কোন লক্ষণ ছিল না। ইঁহার কৃত 'অয়ি দীনদয়ার্দ্রনাথ' শ্লোকে মহাপ্রভুর শিক্ষিত তত্ত্ব বীজরূপে ছিল।'' (শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)

তীর্থভ্রমণকালে পশ্চিম ভারতে শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদের সহিত শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভুর মিলন হয়।মিলিত হওয়ার  সঙ্গে সঙ্গেই উভয়ে প্রেমে মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু বলিলেন,- তীর্থ অনেক দর্শন করিয়াছি,কিন্তু আজ মাধবেন্দ্র পুরীপাদকে দর্শন করিয়া কৃতার্থ হইয়াছি। তীর্থদর্শনের সম্যক ফল লাভ করিয়াছি।শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরী নিত্যানন্দ প্রভুকে ক্রোড়ে করিয়া প্রেমজলে সিক্ত করিয়াছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে উন্মক্ত বিভাবিত চিত্ত শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ একদিন শ্রীগিরিরাজ গোবর্দ্ধন পরিক্রমা করিয়া শ্রীগোবিন্দকুণ্ডে স্নান করতঃ তৎপার্শ্ববর্ত্তী বৃক্ষের নীচে বসিয়া সন্ধ্যা করিতেছেন,এমন সময়ে একটি গোপবালক দুগ্ধভাণ্ড লইয়া সহাস্যবদনে শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদকে বলিলেন,-''তুমি কি চিন্তা করিতেছ,মাগিয়া খাও না কেন,এই দুগ্ধ আনিয়াছি,পান কর।'' বালকের অপূর্ব সৌন্দর্য্য দেখিয়া শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদ চমৎকৃত হইলেন,জিজ্ঞাসা করিলেন,- ''তুমি কে? কোথায় থাক? আমি উপবাসী কি করিয়া জানিলে?'' গোপবালক তদুত্তরে বলিলেন,- ''আমি গোপ,এই গ্রামেই থাকি,আমার গ্রামে কেহ উপবাসী থাকে না,কেহ মাগিয়া খায়, যে মাগিয়া না খায়, তাহাকে আমিই দিই। স্ত্রীগণ জল লইতে এখানে আসিয়াছিলেন,তাঁহারা তোমাকে অনাহারী দেখিয়া এই দুগ্ধ দিয়া আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন,আমার গোদোহনের সময় হইয়াছে,শীঘ্র আমাকে যাইতে হইবে,পরে আসিয়া আমি দুগ্ধভাণ্ডটি লইয়া যাইব।‘’

এই বলিয়া গোপবালক চলিয়া গেলে,তাঁহাকে অন্তর্দ্ধান করিতে দেখিয়া শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদ বিস্মিত হইলেন।দুগ্ধ পান করিয়া দুগ্ধভাণ্ডটি ধুইয়া রাখিলেন এবং অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।বৃক্ষতলে বসিয়া হরিনাম করিতেছেন,শেষ রাত্রি হইল,তন্দ্রা আসায় বাহ্যজ্ঞান শূন্য হইলেন,এমন সময় স্বপ্ন দেখিলেন সেই বালক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে,হাত ধরিয়া তাঁহাকে একটি কুঞ্জে লইয়া গেল,বলিল -  ''এই কুঞ্জে আমি থাকি,শীত,গ্রীষ্ম বর্ষাতে মহাদুঃখ পাইতেছি।গ্রামের লোক আনিয়া আমাকে এখান হইতে উদ্ধার কর,পর্ব্বতের উপর আমাকে একটী মঠ করিয়া স্থাপন কর,বহু শীতল জলে অঙ্গ মার্জ্জন করাও,বহুদিন তোমার পথ নিরীক্ষণ করিয়া বসিয়া আছি,কবে তুমি আসিয়া আমার সেবা করিবে। তোমার প্রেমসেবা অঙ্গীকার করিব এবং দর্শন দিয়া সকল সংসার উদ্ধার করিব। আমার নাম গোবর্দ্ধনধারী গোপাল,শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র ও অনিরুদ্ধের পুত্র বজ্রনাভ আমাকে স্থাপন করিয়াছেন।সেবক আমাকে কুঞ্জে রাখিয়া ম্লেচ্ছ ভয়ে পলাইয়া গিয়াছে,সেই হইতে আমি এখানে আছি। তুমি আসিয়াছ ,ভাল হইয়াছে,আমাকে উদ্ধার কর।।''

শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদের স্বপ্ন ভঙ্গহইল। 'শ্রীকৃষ্ণ গোপালরূপে আসিয়াছিলেন,হায় ! তাঁহাকে চিনিতে পারিলাম না',- বলিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন।শ্রীগোপালের আজ্ঞা পালনের জন্য ক্ষণকাল বাদে নিজের মনকে সুস্থির করিলেন। প্রাতঃস্নানের পর শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ গ্রামের লোক সব একত্র করিয়া বলিলেন,- ''তোমাদের গ্রামের ঠাকুর গোবর্দ্ধনধারী গোপাল কুঞ্জমধ্যে আছে,কুঠার,কোদাল সব লইয়া আইস,কুঞ্জ কাটিয়া তাঁহাকে বাহির করিতে হইবে।'' গ্রামের লোকজন পরমোল্লাসে কুঞ্জ কাটিয়া দেখিল মাটিতৃণাচ্ছাদিত মহাভারী ঠাকুর ! মহা মহা বলিষ্ঠ লোকসব ঠাকুরকে উঠাইয়া পর্ব্বতের উপরে লইয়া পাথরের সিংহাসনে স্থাপন করিল।শ্রীমূর্ত্তির মহাভিষেকের জন্য গ্রামের ব্রাহ্মণগণ গোবিন্দকুণ্ডের জল ছাঁকিয়া নূতন শতঘটে পূর্ণ করিয়া উপনীত হইলেন। দধি,দুগ্ধ,ঘৃত গ্রামে যত ছিল,সন্দেশাদি ভোগ সামগ্রী,নানা উপহার পূজোপকরণে পর্ব্বত পরিপূর্ণ হইল। শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরী স্বয়ং মহাভিষেক কার্য্য সম্পন্ন করিলেন।মহাস্নানান্তে শ্রীঅঙ্গ মার্জ্জন করতঃ বস্ত্র পরিধান করাইলেন এবং শ্রীঅঙ্গে চন্দন,তুলসী পুষ্পমাল্য অর্পণ করিলেন।দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শক্রমে গোপগণ গিরিরাজ গোবর্দ্ধনের যেরূপ অন্নকূট উৎসব করিয়াছিলেন,তদ্রুপ শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ কলিযুগে গোবর্দ্ধনধারী গোপালের অন্নকূট উৎসব করিলেন।

গোপাল প্রকট হইয়াছেন সর্ব্বত্র প্রচারিত হইলে,এক এক গ্রামের ব্রজবাসীগণ এক এক দিন উৎসব করিতে লাগিলেন। ক্রমশঃ মহাধনী ক্ষত্রিয়গণ গোপালের মন্দির করিলেন এবং গোপালের দশসহস্র গাভী হইল।দুই বৎসরকাল গোপালের এইভাবে সেবা চলিতে থাকিলে একদিন শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ স্বপ্নে দেখিলেন, 'গোপাল বলিতেছেন তাঁহার অঙ্গের তাপ দূরীভূত হয় নাই,মলয়জ চন্দনের  দ্বারা অঙ্গ লেপন করিলে তাপ দূর হইবে। 'প্রভুর আজ্ঞা পাইয়া শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ প্রেমাবিষ্ট হইলেন,গোপালের সেবায় উপযুক্ত সেবক নিযুক্ত করিয়া মলয়জ চন্দন সংগ্রহের জন্য পূর্ব্বদেশে যাত্রা করিলেন।‘ শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ গৌড়দেশে শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের গৃহে আসিলেন এবং তথায় শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যকে দীক্ষা দিয়া রেমুণাতে আসিয়া উপনীত হইলেন।রেমুণাতে গোপীনাথের অপূর্ব্ব রূপ দর্শন করিয়া প্রেমে বিহ্বল হইলেন। বহুক্ষণ নৃত্য কীর্ত্তন করিলেন।গোপীনাথের ভোগের পরিপাটী দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন। তথায় কি কি ভোগ লাগে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন। ব্রাহ্মণ তদুত্তরে বলিলেন,-

''সন্ধ্যায় ভোগ লাগে ক্ষীর - 'অমৃতকেলি' নাম।
দ্বাদশ মৃৎপাত্রে ভরি 'অমৃতসমান' ।।
গোপীনাথে'র ক্ষীর বলি প্রসিদ্ধ নাম যার।
পৃথিবীতে ঐছে ভোগ কাঁহা নাহি আর ।।''

ঠিক সেই সময়ে 'অমৃতকেলি' ভোগ ঠাকুরে নিবেদিত হইল।শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ তখন মনে মনে বিচার করিলেন যদি অযাচিত ক্ষীর প্রসাদ পাই,তাহা হইলে তাঁহার আস্বাদন জানিয়া গোপালকে তদ্রুপ ক্ষীর ভোগ দেব। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধিক্কার দিলেন,- 'আমার ক্ষীর খাইবার ইচ্ছা হইল'? ঠাকুরের আরতি দর্শন ও প্রণাম করিয়া মন্দিরের বাহিরে গ্রামের শূন্যহাটে বসিয়া হরিনাম করিতে লাগিলেন।মাধবেন্দ্র পুরীপাদ অযাচক বৃত্তি,ক্ষুধা - তৃষ্নার বোধ রহিত,সর্ব্বদা প্রেমামৃতপানে তৃপ্ত।এদিকে পূজারী তাঁহার কৃত্য সমাপন করিয়া শয়ন করিলে ঠাকুর স্বপ্নে তাঁহাকে বলিলেন,-

''উঠহ পূজারী, কর দ্বার বিমোচন।
ক্ষীর এক রাখিয়াছি সন্ন্যাসী কারণ।।
ধড়ার অঞ্চলে ঢাকা ক্ষীর এক হয়।
তোমরা না জানিলা তাহা আমার মায়ায়।।
মাধবপুরী, সন্ন্যাসী  আছে হাটেতে বসিঞা।
তাহাকে ত' এই ক্ষীর শীঘ্র দেহ লঞা।।''

স্বপ্ন দেখিয়া পূজারী আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া উঠিলেন।স্নানান্তে কপাট খুলিয়া দেখিলেন,ঠাকুরের বসনের আঁচলে ঢাকা একটি ক্ষীর। সেই ক্ষীর লইয়া মাধব পুরীর অন্বেষণে পূজারী হাটে হাটে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন এবং তাঁহাকে এই বলিয়া আহ্বান করিতে লাগিলেন,-
''ক্ষীর লহ এই,যাঁর নাম মাধবপুরী।
তোমা লাগি' গোপীনাথ ক্ষীর কইল চুরী।।
ক্ষীর লঞা সুখে তুমি করহ ভক্ষণে।
তোমা সম ভাগ্যবান নাহি ত্রিভুবনে।।''

''
প্রভু কহে,নিত্যানন্দ, করহ বিচার,
পুরীসম ভাগ্যবান জগতে নাহি আর।
দুগ্ধদান ছলে কৃষ্ণ যারে দেখা দিল,
তিনবারে স্বপ্নে আসি যাঁরে আজ্ঞা দিল।
যাঁর লাগি গোপীনাথ ক্ষীর কৈল চুরি,
অতএব নাম হৈল ক্ষীরচোরা করি''।।

''
দীনদয়ার্দ্রনাথ ! ওহে মথুরানাথ ! কবে তোমাকে দর্শন করিব ! তোমার দর্শনাভাবে আমার কাতর হৃদয় অস্থির হইয়া পড়িয়াছে ! হে দয়িত,আমি এখন কি করিব ?''
শ্রীমন্মহাপ্রভু এই শ্লোক পাঠ করিয়া প্রেমোন্মত্ত হইয়াছিলেন।নিত্যানন্দ প্রভু তাঁহাকে ক্রোড়ে ধারণ করিয়াছিলেন।

শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে তিরোধানলীলা করিয়াছিলেন I


No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...