Sunday, April 19, 2020


মহাজন বাণী
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

আজানুলম্বিত - ভুজৌ কনকাবদাতৌ,
সংকীর্ত্তনৈকপিতরৌ কমলায়তাক্ষৌ।
বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্ম্মপালৌ,
বন্দে জগৎপ্রিয়করৌ করুণাবতারৌ।

আমরা প্রায়ই বিভ্ৰান্ত হয়ে থাকি এই ভেবে যে , কোন মহাত্মার নির্দ্দেশে আমরা জীবনপথে এগিয়ে যাবো, কোন মহাত্মার পদাঙ্ক আমরা অনুসরণ করবো বা কোন মহাত্মার অভিমত আমরা গ্ৰহণ করবো ?

এই বিষয়ে আমরা বৈদিক শাস্ত্রের নির্দ্দেশ অনুসন্ধান করতে পারি আমাদের মনুষ্য জন্মের কল্যাণাৰ্থে মহৰ্ষি ব্যাসদেব সমস্ত বেদশাস্ত্ৰ লিপিবদ্ধ করেছেন। 'নানা মুনি নানা মত' - পথ নির্দ্দেশ করলেও ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে যখন যক্ষ প্ৰশ্ন করলেন, প্ৰকৃত পথ কি ?/ কঃ পন্থাঃ ?
যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন,-
‘’মহাজনো যেন গতঃ পন্থাঃ।''

অর্থাৎ,- মহাজনগণ যে পথে গমন করেছেন, বা মহাজনদের দ্বারা নিৰ্ধারিত পথ হচ্ছে প্ৰকৃত পথ। (মহাভারত বনঃ )

শ্ৰীমদ্ভাগবতে মহৰ্ষি ব্যাসদেব উল্লেখ করলেন, এই মহাজন কে ?
অজামিলকে নেওয়ার জন্য যখন যমদূতেরা এসেছিলেন তখন বিষ্ণুদূতেরা যমদূতদের সবিক্ৰমে বাঁধা দিলেন অগত্যা যমদূতেরা তাদের প্রভু যমরাজের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ''হে মহারাজ পাপী অজামিলকে ধৰ্মতঃ পাশবদ্ধ করতে গিয়ে আমরা বিপন্ন হয়েছি,চতুর্ভূজ অস্ত্ৰধারী ব্যক্তিরা আমাদের ধর্ম্মতত্ত্ব জ্ঞানহীন বলে নির্দ্দেশ দিয়ে বিতাড়িত করল, আপনি দয়া করে বলুন, কে প্ৰকৃত ধর্ম্ম তত্ত্ববেত্তা এবং ব্ৰহ্মাণ্ডের আর কত জন ধর্ম্ম তত্ত্ববেত্তা আছেন''?

শ্ৰীযমরাজ উত্তর দিলেন,- ধর্ম্মের বিচার অতি সূক্ষ, সবাই বুঝতে পারে না। ধর্ম্মের প্রকৃত তত্ত্ববেত্তা  দ্বাদশজন। 'দ্বাদশ মহাভাগবৎ',---
''স্বয়ম্ভুর্নারদঃ শম্ভুঃ কুমারঃ কপিলো মনুঃ।
প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মো বলিরব্যাসকির্বয়ম।।'' ---(শ্রীমদ্ভাগবত  //২০)

অর্থাৎ,- দ্বাদশ মহাভাগবৎ যথাক্রমে,---
১। স্বয়ম্ভূ - যিনি ভগবানের নাভিপদ্ম থেকে উদ্ভুত, সৃষ্টির আদি জীব, জড় ব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা শ্রীব্রহ্মা;
২। শ্রীনারদ মুনি - যিনি জড়লোক বৈকুণ্ঠলোক সর্বত্র অনায়াসে যাত্রা করেন, ব্যাসদেবের গুরুদেব;
৩। শম্ভু - পার্বতীদেবীর পতি শ্রীশিব;
৪। কুমার - ব্রহ্মার মানস পুত্র সনৎকুমার;
৫। কপিলো - শ্রীদেবহূতির পুত্র শ্রীকপিলদেব;
৬। মনু - মানব জাতির আদি পিতা শ্রীস্বায়ম্ভূব মনু;
৭। প্রহ্লাদ - হিরণ্যকশিপুর পুত্র, যাঁকে ভগবান শ্রীনৃসিংহরূপে কৃপা করেছিলেন ;
৮। জনক - মিথিলার রাজা জনক, সীতাদেবীর পিতা;
৯। ভীষ্ম - শ্রীগঙ্গার পুত্র শ্রীভীষ্মদেব;
১০। বলি - যিনি ভগবানের বামন অবতারে আত্মসমর্পণ করেছিলেন শ্রীবলিমহারাজ;
১১। বৈয়াসকি - ত্রিকালজ্ঞ মহর্ষি শ্রীব্যাসদেবের পুত্র মুক্তপুরুষ শ্রীশুকদেব গোস্বামী;
১২। যম - মৃত্যুর দেবতা শ্রীযমরাজ আমি।

শ্রীমদ্ভাগবতে এই দ্বাদশ মহাজনের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকেই পরমভাগবত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভজন করতে নির্দ্দেশ দিয়েছেন।

''দ্বাদশৈতে বিজানীমো ধর্মং ভাগবতং ভটাঃ।
গুহ্যং বিশুদ্ধং দুর্বোধং যং জ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে।।'' ---(শ্রীমদ্ভাগবত //২১)

শ্রীযমরাজ তাঁহার দূতদের বলছেন,- "আমরা এই দ্বাদশ জন প্রকৃত ধর্মের তত্ত্ব জানি। হে ভৃত্যগণ, এই দিব্য ধর্ম্ম যা ভাগবতধর্ম্ম বা ভগবৎপ্রেম ধর্ম্ম নামে পরিচিত, তাহা জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা কলুষিত নয়। তা অত্যন্ত গোপনীয় এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্বোধ্য, কিন্তু কেউ যদি ভাগ্যক্রমে তা হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ পায়, তা হলে সে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের আনন্দময় ধামে ফিরে যায়।"

ধর্মতত্ত্ব 'গোপনীয়' হলেও শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে শরণাগত জন তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, 'দুর্বোধ্য' হলেও মহাজন পরম্পরা ধারায় আশ্রিত হলে তা সহজেই বোধগম্য হয়। ধর্মরাজ যম তাঁহার অনুচর যমদূতদের বললেন, যারা সর্বদা হরিনাম পরায়ণ, কৃষ্ণভক্তি পালন করে, শুচি শুদ্ধ ধার্মিক জীবনযাপন করেন, কখনো তাদের কাছে যাবে না। আর যারা হরিনাম করেনা, বিষ্ণুব্রত পালন করেনা, কৃষ্ণভক্তগণকে নিন্দা করেন, সর্বদা অশুচী অধার্মিক জীবনযাপন করেন,তাদের যমপাশে বেঁধে যমালয়ে নিয়ে আসবে।

আজ আমরা দুই মহাজন ব্রহ্মা নারদমুনির বার্ত্তালাপ শুনবো,---
একসময় নারদমুনি মন্দাকিনীর তটে তপস্যা করছিলেন। তখন তিনি দৈববাণী শুনতে পেলেন,---
শ্ৰীহরি যদি আরাধিত না হন, তবে তপস্যার কি দরকার ?
শ্ৰীহরি যদি আরাধিত হন, তবে তপস্যারও কি দরকার ?

দৈববাণী শুনে নারদ শ্ৰীহরি স্মরণ করছিলেন এবং তখন পিতৃদেব ব্ৰহ্মাকে দেখতে পেলেন ব্ৰহ্মাকে প্ৰণতি নিবেদন করে সজলপূৰ্ণ নয়নে নারদ বললেন, ''হে পিতা, এই দৈববাণীর অৰ্থ কি ?''

ব্ৰহ্মা বললেন,- হে বৎস ! যদি কোনও ব্যক্তি ভক্তি সহকারে শ্ৰীহরির আরাধনা করেন, তবে সেই ব্যক্তির তীৰ্থভ্ৰমণ, তপস্যার প্রয়োজন নেই। ভারতবর্ষে কৃষ্ণমন্ত্ৰ - উপাসক জীবন্মুক্ত ব্যক্তির পক্ষে তপস্যার প্রয়োজন হয় না। হে নারদ, শ্ৰীকৃষ্ণনাম মন্ত্ৰ গ্ৰহণ মাত্ৰেই তার বংশের শত পুরুষ বন্ধুবান্ধবরাও অনায়াসে পবিত্ৰ হয়। শ্ৰীকৃষ্ণসেবা থেকে অন্য কোন ধৰ্ম বড় নয়, অন্য কোন তপস্যা শ্ৰেয় নয়। কৃষ্ণসেবা পরায়ণ ব্যক্তিদের তপস্যার পরিশ্রম অনাবশ্যক। হে পুত্ৰ, শ্ৰীকৃষ্ণমন্ত্ৰে ব্ৰতী ব্যক্তিই মহা পবিত্ৰ। তার তীৰ্থস্থান, তার অনশন, তার বেদ অধ্যয়ন বিড়ম্বনা মাত্ৰ।

হে বৎস, আগুন পবিত্ৰ, নির্ম্মল জল পবিত্ৰ, ভারতবৰ্ষ পবিত্র এবং তীৰ্থস্বরপ তুলসীপত্ৰ পরম পবিত্ৰ। কিন্তু কৃষ্ণনাম - পরায়ণ, কৃষ্ণসেবা পরায়ণ ব্যক্তি অবলীলাক্ৰমে এই সকলকে পবিত্ৰ করেন, আর এরাও সাদরে কৃষ্ণভক্ত ব্যক্তির স্পৰ্শ বাঞ্ছা করেন। বসুন্ধরা হরিভক্তের পদধূলি দ্বারা তৎক্ষণাৎ পবিত্ৰ হন। হে নারদ, জানবে যে, এই ব্ৰহ্মাণ্ডে শ্ৰীকৃষ্ণসেবক অপেক্ষা কোন বস্তু বা কোনও ব্যক্তি অধিক পবিত্ৰ নয়। যে ব্যক্তি প্ৰতিদিন শ্ৰীকৃষ্ণপূজা করেন এবং শ্ৰীকৃষ্ণচরণামৃত মহাপ্ৰসাদ গ্ৰহণ করেন, সেই মহা পবিত্ৰ।

হে নারদ, কৃষ্ণভক্ত যে বংশে জন্মগ্রহণ করেন সেই বংশ পবিত্ৰ হয়। জগতে যে ব্যক্তি কৃষ্ণভজনা করেনা, তার তপস্যা, তার কৰ্মপ্ৰচেষ্টা তার পরিশ্রম বৃথা। গঙ্গাজল যেমন মদের ভাণ্ডকে পবিত্ৰ করতে পারে না, সেরকম বৈদিক কৰ্মকাণ্ডীয় যজ্ঞ, উপবাস, তপস্যা, ব্ৰত, দান শুভকৰ্ম, সবই অভক্ত ব্যক্তিকে পবিত্র করতে পারে না। শ্ৰীকৃষ্ণের প্রতি যে ভক্তি - পরায়ণ নয়, সেই ব্যক্তি তীৰ্থক্ষেত্রে গমন করে যদি স্নান করতে যায় তবে তীৰ্থ বিচলিত হন। বসুন্ধরা অভক্তের ভারে দুঃখে কম্পিত হয়ে থাকেন

হে বৎস, শ্ৰীকৃষ্ণের কথাই বেদশাস্ত্রের সারবস্তু যে মহাত্মা স্বপ্নে জাগরণে শ্ৰীকৃষ্ণের চিন্তা করেন, তিনি নিষ্পাপ হয়ে জগৎকে পবিত্ৰ করেন, ভগবানের সুদৰ্শন চক্ৰ সেই মহাত্মাকে সুরক্ষিত করেন। ''শ্ৰীকৃষ্ণের নিরন্তর স্মরণকারী ভক্ত অপেক্ষা আত্মা, প্ৰাণ, দেহ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, আমি, শিব তার কাছে কিছুই প্রিয় নয়।'' পরমপ্ৰভু শ্ৰীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভক্তগত প্ৰাণ এবং ভক্তগণ হচ্ছেন কৃষ্ণগত প্ৰাণ। ভক্ত শ্ৰীকৃষ্ণকে ধ্যান করেন , শ্ৰীকৃষ্ণ ভক্তের ধ্যান করেন

হে নারদ, যারা শ্ৰীকৃষ্ণসেবা - পরায়ণ নয়, তাদের জ্ঞান, তাদের তপস্যা, তাদের ব্ৰত, তাদের নিয়ম, তাদের তীৰ্থ স্নান, তাদের পুণ্যকৰ্ম সমস্তই নিস্ফল। যারা ব্ৰাহ্মণ, অথচ কৃষ্ণভক্ত নয়, তারা ধৰ্মভ্ৰষ্ট পতিত জীব। ‘’কৃষ্ণভক্তিহীন ব্ৰাহ্মণ অপেক্ষা স্বধৰ্মচারশীল চণ্ডাল এমনকি কুকুর শূকরেরাও ভালো।‘’ হে নারদ, ধর্ম্মহীন ব্ৰাহ্মণেরা মাছ - মাংস আহার করে যা তাদের তা গ্ৰহণ করা উচিত নয়, সেইগুলিও তারা ভক্ষণ করে। প্ৰতিদিন বিপরীত ধর্ম্মচার দ্বারা তারা পতিত হয়ে চণ্ডাল  অপেক্ষাও অধম হয়।

''সর্বে ভবন্তু সুখিন,সর্বে সন্তু নিরাময়া।
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু,মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত।।''
ওম শান্তি শান্তি শান্তি। (বৃহদারন্যক উপনিষদ //১৪)

অর্থাৎ সবাই যেন সুখী হয়, সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন। সকলে শান্তি লাভ করুন।।
জয় শ্রীরাধাকৃষ্ণের জয়। জয় শচীনন্দন গৌরহরির জয়।।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...