সনাতন শিক্ষা
শ্রী
শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল
সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম
I
‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব
তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ
স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে
হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ।।‘’
গুরবে
গৌরচন্দ্রায় রাধিকায়ৈ তদালয়ে।
কৃষ্ণায়
কৃষ্ণভক্তায় তদ্ভক্তায় নমো নমঃ।।
জীবের স্বরুপ, দুঃখের কারণ ও তাহার প্রতিকার।
ষড়গোস্বামীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রীল সনাতন গোস্বামীপাদ কলিযুগ পাবন অবতার পতিতপাবন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর নিকট তিনটি প্রশ্ন নিবেদন করিয়াছিলেন।
‘’কৃপা করি যদি মোরে করিয়াছ উদ্ধার।
আপন কৃপাতে কহ কর্ত্তব্য আমার।।
কে আমি, কেন আমারে জারে তাপত্রয়।
ইহা নাহি জানি মুঞি কেমনে হিত হয়।।
সাধ্য - সাধন তত্ত্ব পুছিতে নাহি জানি।
কৃপা করি সব তত্ত্ব কহিবে আপনি।‘’
প্রথম প্রশ্নঃ- আমি কে?
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ- আমি ত্রিতাপে জর্জ্জরিত কেন?
তৃতীয় প্রশ্নঃ-আমার কিসে হিত হইবে।
আরো একটি প্রশ্ন তিনি আধা ভাঙ্গাভাবে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। বলিয়াছেন - সাধ্য - সাধনতত্ত্ব বিষয়ক প্রশ্ন আমি জিজ্ঞাসা করিতে জানি না। তুমি কৃপা করিয়া "সব
তত্ত্ব" যদি
বল তাহা হইলে পরমানন্দে শুনিয়া ধন্য হইব।
সনাতনের প্রশ্নই 'সনাতন', কারণ চিরন্তন কালের চিন্তাশীল মানবের ইহাই জিজ্ঞাস্য। ইহা প্রতিটা মানবের জানা দরকার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাহার নিরুপম ভাষায় প্রশ্নগুলির উত্তর প্রদান করিয়াছেন,-
প্রথম প্রশ্নের উত্তরঃ---
জীবের 'স্বরূপ' হয়- কৃষ্ণের 'নিত্যদাস'।
কৃষ্ণের 'তটস্থা শক্তি', ভেদাভেদ প্রকাশ।। (চৈঃচঃ মধ্য ২০/১০৮)
শ্রীকৃষ্ণ নিত্যবস্তু ও জীবাত্মাও নিত্যবস্তু। এজন্য তাহাদের সেব্য-সেবক স ম্বন্ধটিও নিত্য তাই জীব নিত্যদাস বলিয়াছেন।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরঃ---
জীবের দুঃখের মূল কারণ
কৃষ্ণ ভুলি ' সেই জীব অনাদি-বহির্মুখ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ।। (চৈঃচঃ মধ্য ২০/১০৮)
অর্থাৎ,- অনাদি বহির্ম্মুখ জীব কৃষ্ণকে ভুলিয়া আছে আর কৃষ্ণ বহির্ম্মুখ জীবকে দুঃখ দেওয়াই মায়ার কাজ। দুঃখ দানের উদ্দেশ্য তাহাকে আঘাত দিয়া কৃষ্ণোন্মুখ করিয়া তোলা। দুঃখ পাইলে জীবের স্বরুপ স্মৃতি জাগ্রত হইয়া যায়।
'কৃষ্ণ নিত্যদাস ' জীব
তাহা ভুলি'গেল।
এই দোষে মায়া তার গলায় বান্ধিল।। (চৈঃচঃ মধ্য ২২/২৪)
'জীব যে কৃষ্ণের নিত্যদাস' এই সত্য বিস্মৃত হওয়াতেই মায়া জীবকে নানা প্রকার প্রলুব্ধ ও বিমোহিত করে ত্রিগুণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ করলেন।
কভু স্বর্গে উঠায়, কভু নরকে ডুবায়।
দণ্ড্যজনে রাজা যেন নদীতে চুবায়।। (চঃ চৈঃ মধ্য ২০/১১৮)
এই জড় জগতের জীব কখনও স্বর্গলোকে উন্নত হয় জাগতিক সুখ ভোগ করে এবং কখনও নরকে অধঃপতিত হয়ে দুঃখ ভোগ করে, ঠিক যেমন রাজা অপরাধীকে নদীর জলে চুবিয়ে এবং তারপর অল্পক্ষণের জন্য জল থেকে তুলে দণ্ডদান করেন।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরঃ-
সাধু - শাস্ত্র - কৃপায় যদি কৃষ্ণোন্মুখ হয়।
সেই জীব নিস্তরে, মায়া তাহারে ছাড়ায়।। (চঃচৈঃ মধ্য ২০/১২০)
মায়াকে পিছনে ফেলিয়া কৃষ্ণপানে তাকালেই কৃষ্ণ স্মৃতি জাগিবে এবং দুঃখের চির নিভৃত্তি হইবে। যে জীব কৃষ্ণোন্মুখ মায়া তাহাকে ছাড়িয়া যায় বলিয়া দুঃখ কখনই তাহার আর নিকটবর্তী হইতে পারে না। কৃষ্ণোন্মুখ হইবার উপায় হইল সাধু ও শাস্ত্র। সাধুর জীবন কৃষ্ণময়, আর শাস্ত্র কৃষ্ণ কথায় পূর্ণ। সাধু কৃপা আর শাস্ত্র কৃপাতেই জীব কৃষ্ণোন্মূখ হইতে পারিবে। কৃষ্ণোন্মুখ হইলেই জীব দুঃখ হইতে চির নিস্কৃতিলাভ করিবে।
মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বতঃ কৃষ্ণজ্ঞান।
জীবেরে কৃপায় কৈলা কৃষ্ণ বেদ-পুরাণ।। (চঃচৈ মধ্য ২০/১২২)
মায়ার প্রভাবে আচ্ছন্ন বদ্ধ জীব তার নিজের চেষ্টায় কৃষ্ণ স্মৃতি জাগরিত করতে পারে না। তাই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে জীবকে বেদ পুরাণাদি স্বার্থ গ্রন্থাবলী দান করেছেন।
স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ, 'গোবিন্দ' পর নাম।
সর্বৈশ্বর্যপূর্ণ যাঁর গোলোক
নিত্য ধাম।। (চৈঃ
চঃ ২০/১৫৫)
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, তাঁর আরেক নাম 'গোবিন্দ' তিনি সর্ব ঐশ্বর্য পূর্ণ এবং গোলোক তাঁর নিত্য ধাম।
কৃষ্ণ সূর্যসম; মায়া হয় অন্ধকার।
যাঁহা কৃষ্ণ, তাঁহা নাহি মায়ার অধিকার।। (চৈঃচঃ মধ্য ২২/৩১)
শ্রীকৃষ্ণকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, এবং মায়াকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সূর্যকিরণের প্রকাশ হলে যেমন আর সেখানে অন্ধকার থাকতে পারে না, তেমনি কেউ যদি কৃষ্ণভক্তির পন্থা অবলম্বন করেন, তখন মায়ার অন্ধকার তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে দূর হয়ে যায়।
জীবের কল্যাণকর অমিয় বাণীই সনাতনকে লক্ষ্য করিয়া শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য
মহাপ্রভু উপদেশ দিয়া গিয়াছেন। এই শিক্ষা নিয়ে আমরা আত্মস্মৃতি জ্ঞান লাভ করিয়া সাধু-শাস্ত্র সঙ্গ করিয়া দুঃখ হইতে নিস্তার লাভ করিবার প্রয়াস করিব। এই হউক আমাদের জীবনের ব্রত ও একমাত্র উদ্দেশ্য । এখন আপনি স্বয়ং ভাবুন, আপনার জীবনের ব্রত বা উদ্দেশ্যে কি হওয়া উচিত ?
(১)
শ্রীগুরু চরণ পদ্ম, কেবল ভকতি সদ্ম
বন্দোঁ মুঞি সাবধান মতে I
যাঁহার প্রসাদে ভাই, এ ভব তরিয়া যাই
কৃষ্ণ প্রাপ্তি হোয় যাঁহা হৈতে II
(২)
গুরুমুখ পদ্ম বাক্য, চিত্তেতে করিয়া ঐক্য
আর না কোরিহো মনে আশা I
শ্রীগুরু চরণে রতি, এই সে উত্তম গতি,
যে প্রসাদে পূরে সর্ব্ব আশা II
(৩)
চক্ষুদান দিলা যেই, জন্মে - জন্মে প্রভু সেই,
দিব্যজ্ঞান হৃদে প্রকাশিত I
প্রেম ভক্তি যাঁহা হৈতে, অবিদ্যা - বিনাশ যাতে,
বেদে গায় যাঁহার চরিত II
(৪)
শ্রীগুরু করুণাসিন্ধু, অধম জনার বন্ধু,
লোকনাথ লোকের জীবন I
হা হা প্রভু! কর দয়া, দেহো মোরে পদছায়া,
এবে যশঃ ঘুষুক ত্রি-ভুবন II
(৫)
বৈষ্ণব চরণরেণু, ভূষণ করিয়া তনু,
যাহা হৈতে অনুভব হয় I
মার্জন হয় ভজন, সাধু সঙ্গে অনুক্ষণ,
অজ্ঞান অবিদ্যা পরাজয় II
(৬)
জয় সনাতন রূপ, প্রেম ভক্তি রস কূপ,
যুগল উজ্জ্বল-ময় তনু I
যাহার প্রসাদে লোক, পাসরিল সব শোক,
প্রকট-কলপ-তরু জনু II
(৭)
প্রেমভক্তি রীতি যত, নিজ গ্রন্থে সুবেকত,
লিখিয়াছেন দুই মহাশয় I
যাহার শ্রবণ হৈতে, প্রেমানন্দে ভাসে চিত্ত,
যুগল মধুর রসাশ্রয় II
(৮)
যুগলকিশোর প্রেম, লক্ষবাণ যেন হেম,
হেন ধন প্রকাশিল যারা I
জয় রূপ-সনাতন, দেহো মোরে প্রেম-ধন,
সে রতন মোরে গলে হারা II
(৯)
ভাগবত শাস্ত্রমর্ম্ম, নব বিধা ভক্তিধর্ম্ম,
সদাই করিব সুসেবন I
অন্য দেবাশ্রয় নাই, তোমারে কহিল ভাই,
এই ভক্তি পরমভজন II
(১০)
সাধু শাস্ত্র গুরুবাক্য, হৃদয়ে করিয়া ঐক্য,
সতত ভাসিব প্রেম মাঝে I
কর্ম্মী জ্ঞানী ভক্তিহীন, ইহাকে করিব ভিন্ন,
নরোত্তম এই তত্ত্ব গাজে II
No comments:
Post a Comment