Sunday, April 26, 2020


পরমার্থ লাভের পন্থা
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I
‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন I I
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

‘’আজানুলম্বিত - ভুজৌ কনকাবদাতৌ,
সংকীর্ত্তনৈকপিতরৌ কমলায়তাক্ষৌ।
বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্ম্মপালৌ,
বন্দে জগৎপ্রিয়করৌ করুণাবতারৌ।‘’

'জ্ঞান - ভক্তি মার্গ সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্গম হওয়ার কারণে শ্রীশুকদেব গোস্বামীপাদ পরমার্থ লাভের জন্য সহজ সরল পন্থা নির্দেশ করিয়াছেন, সাধুসঙ্গ হরিনাম সংকীর্ত্তন। সাধুসঙ্গ বহুভাগ্যে লাভ হয়, কিন্তু সদগ্রন্থ পাঠও সাধুসঙ্গ। সদগ্রন্থ পাঠ করিলেও সাধুসঙ্গের অভীস্পিত ফল লাভ হয়। মানবগণ যদি শ্রদ্ধা সহকারে নিত্য দৃঢতার সহিত শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্র পাঠ করেন আর শুনেন তবে শ্রীভগবানের পরম কৃপা লাভ অবশ্য ইহইবে।
‘’সৃনত শ্রদ্ধয়া নিত্যম দৃঢতশ্চ প্রতিষ্টিতম।
নাতি দীর্ঘেন কালেন ভগবান বৃষতে হৃদি।।‘’

বৈদিকযুগে দেবর্ষি নারদ, শ্রীশুকদেব, শ্রীউগ্রশ্রবা, সুত, শ্রীভরত মহারাজ, শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ, মহারাজ অম্বরীষ প্রভৃতি সাধু মহাপুরুষগণের সঙ্গ লাভে মানব জীবন ধন্য হইয়াছে।

পরমার্থ লাভের দ্বিতীয় সহজপন্থা হল হরিনাম সংকীর্ত্তন। যুগে যুগে সর্বশাস্ত্রে ভুবনমঙ্গল নাম সংকীর্ত্তনের মহিমা কীর্ত্তন করা হইয়াছে। তাই জগতবাসীর কল্যাণের জন্য নাম-মাহাত্ম্য কীর্ত্তন  করিয়া শ্রীউগ্রশ্রবা সুত মহাশয় শ্রীমদ্ভাগবতের কাহিনী সমাপ্ত করিয়াছেন। সংসারী বদ্ধজীবকে তিনি সাবধান করিয়া বলিয়াছেন,অদূরদর্শী বুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়া কেবল নিত্য দিনের অর্থোপার্জন, সুখ - সাচ্ছন্দতা দেখিলেই চলিবেনা, চিরদিনের পাথেয় সংগ্রহ করিতে হইবে। হরিনাম সংকীর্ত্তনে ত্রিতাপ যথা আদিদৈবিক আদিভৌতিক আধ্যাত্মিক আদি সর্ববিধ দুঃখ বিনষ্ট হয়।

ভাগবত শাস্ত্রমর্ম্মনব বিধা ভক্তিধর্ম্ম,
সদাই করিব সুসেবন I
অন্য দেবাশ্রয় নাইতোমারে কহিল ভাই,
এই ভক্তি পরমভজন II
সাধু শাস্ত্র গুরুবাক্যহৃদয়ে করি য়া ঐক্য,
সতত ভাসিব প্রেম মাঝে I
কর্ম্মী জ্ঞানী ভক্তিহীনইহাকে করিব ভিন্ন,
নরোত্তম এই তত্ত্ব গাজে II

‘’ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।‘’ (গীতা /৬২)

‘’ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।‘’ (গীতা /৬৩)

অর্থাৎ, - ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ, মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়। তাৎপর্য - যার অন্তরে ভগবদ্ভক্তির উদয় হয়নি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করা মাত্রই তার মনে আসক্তি জন্মায়। ইন্দ্রিয়গুলিকে সঠিকভাবে নিযুক্ত করা দরকার, তাই সেগুলিকে যখন ভগবানের প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত করা না হয়, তখন সেই ইন্দ্রিয়গুলি জড়-জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।

জড়-জগতের সকলেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হন, এমন কি ব্রহ্মা এবং শিবও এর দ্বারা প্রভাবিত - স্বর্গলোকের অন্যান্য দেব-দেবীদের তো কোন কথাই নেই। জড় জগতের এই গোলক-ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসবার একমাত্র উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হওয়া। এক সময় মহাদেব গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, পার্বতী যখন কামার্ত হয়ে তাঁর সঙ্গ কামনা করেন, তখন তাঁর ধ্যান ভঙ্গ হয় এবং তিনি পার্বতীর সঙ্গে মিলিত হন, ফলে কার্ত্তিকের জন্ম হয়। ভগবানের একনিষ্ঠ ভক্ত ঠাকুর হরিদাসও এভাবে স্বয়ং মায়াদেবীর দ্বারা প্রলুব্ধ হন, কিন্তু ভগবানের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তির প্রভাবে তিনি অনায়াসে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিষ্ঠাবান ভক্ত ভগবানের দিব্য সাহচার্য লাভ করেন এবং অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ লাভ করেন, যার ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ পরিহার করতে পারেন।

ভগবদ্ভক্তির প্রভাবে মন আপনা থেকেই আসক্তি রহিত হয়ে পড়ে এবং হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয়। সেটিই হচ্ছে সাফল্যের রহস্য। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্তি ছাড়া জোর করে ইন্দ্রিয় - দমন করার চেষ্টা করলে তা কখনই ফলপ্রসূ হয় না, কারণ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনায় মন উন্মত্ত হয়ে ওঠে। শ্রীল রূপ গোস্বামী আমাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছেন -
‘’প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবস্তুনঃ।
মুমুক্ষুভিঃ পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথ্যতে।।‘’  (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু //২৫৬)
অর্থাৎ,-
শ্রীহরি-সেবায় যাহা অনুকুল।
বিষয় বলিয়া ত্যাগে হয় ভুল।।
আর
‘’অনাসক্তস্য বিষয়ান্ যথার্হমূপযুঞ্জতঃ।
নির্ব্বন্ধঃ কৃষ্ণসম্বন্ধে যুক্তং বৈরাগ্যমুচ্যতে।।‘’ (শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু)
অর্থাৎ,-
‘’আসক্তি রহিত সম্বন্ধ সহিত, বিষয়সমূহ সকলি মাধব।‘’

ভগবদ্ভক্তির বিকাশ হলে ভক্ত বুঝতে পারেন, সব কিছু দিয়েই ভগবানের সেবা করা যায়। যারা ভগবৎ-তত্ত্ব জানে না, তারা কৃত্রিম উপায়ে জড় বিষয়বস্তু পরিহার করার চেষ্টা করে এবং ফলস্বরূপ, যদিও তারা জড় বন্ধন থেকে মুক্তির কামনা করে, কিন্তু এই রকম শত চেষ্টা করেও তাদের হৃদয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয় না। তাদের তথাকথিত বৈরাগ্যকে বলা হয় ফল্গু অর্থাৎ অসার। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্ত জানেন কিভাবে সব কিছু ভগবানের সেবায় ব্যবহার করতে হয়; তাই তিনি আর জড় চেতনার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন না।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, নির্বিশেষবাদীদের মতে, ভগবান অথবা পরমতত্ত্ব হচ্ছেন নিরাকার, তাই তিনি খেতে পারেন না, ভোগও করতে পারেন না। সেই জন্য নির্বিশেষবাদীরা জোর করে ইন্দ্রিয়-দমন করবার অভিপ্রায়ে ভাল খাবার আদি সব রকমের ভোগ পরিত্যাগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ভগবদ্ভক্ত জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম ভোক্তা এবং ভক্তিভরে যা কিছু নৈবেদ্য তাঁকে নিবেদন করা হয়, তা তিনি ভোজন করেন। তাই, ভক্ত উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য ভগবানের ভোগের জন্য নিবেদন করে, সেই নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করেন। ভক্তকে তাই জোর করে ইন্দ্রিয়-দমন করতে হয় না। এভাবেই ভগবানকে নিবেদন করার ফলে সব কিছু পবিত্র হয়ে ওঠে এবং সেই ভগবৎ-প্রসাদ গ্রহণ করার ফলে অধঃপতনের আর কোন সম্ভাবনা থাকে না।

পক্ষান্তরে, নির্বিশেষবাদীরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার প্রয়াসে সব কিছুই পার্থিব বলে পরিত্যাগ করতে সচেষ্ট হয়, কিন্তু এই ধরনের কৃত্রিম বৈরাগ্যের ফলে তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। সামান্য উত্তেজনাতেই তাই তাদের সংযমের বাঁধ ভেঙে যায় এবং তারা জড় জগতের আবর্তে পতিত হয়। সেই জন্যই এই সমস্ত মুক্তিকামীরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার পরেও, ভগবদ্ভক্তিতে  অবলম্বন না থাকার ফলে, আবার জড়া প্রকৃতিতে পতিত হয়।

শ্রীচৈতন্যদেব এই কলিযুগে, আর শ্রীমদ্ভাগবত দ্বাপরের শেষে অবতীর্ণ হয়ে পরস্পরের যোগাযোগে একটা অদ্ভুত পন্থার আবির্ভাব হয়েছে, যে একমাত্র ভগবানের নামানুশীলনের দ্বারাই সর্বকার্য্য সিদ্ধ হবে বা সর্বার্থলাভ হতে পারে কেবল শব্দানুশীলনের দ্বারা, কিন্তু সেই শব্দ -  শব্দব্রহ্ম শব্দব্রহ্মের অনুশীলনের দ্বারাতেই, হরিকীর্ত্তনের দ্বারাতেই সর্বার্থ  সিদ্ধ হতে পারে
‘’কলের্দোষনিধেরাজন্ অস্তি হ্যেকো মহানগুণঃ I
কীর্ত্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গঃ পরং ব্রজেৎ I I‘’ (শ্রীমদ্ভাগবত)

‘’কলি সমস্ত দোষের বটে, তথাপি হে রাজন ! কলির একটি মহাগুণ এই যে, কৃষ্ণকীর্ত্তনে জীব মায়াবদ্ধ হতে মুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণরূপ পরতত্ত্ব লাভ করে ‘’

‘’নাম-সংকীর্তন যস্য সর্বপাপ প্রণাশনম্।
প্রণামো দুঃখশমনস্তং নমামি শ্রীহরিং পরম্।।‘’
যে হরিনাম সংকীর্ত্তন করিলে ইহকাল পরকালের পাপরাশি নিঃশেষে দগ্ধ হয়,আমি সেই নামরূপী পরমাত্মা স্বরূপ শ্রীহরিকে প্রণাম করি।

হে আমার প্রাণধন কৃষ্ণ তুমি আমাদের হৃদয়ে ভক্তির ভাব জাগিয়ে দাও। সবাই একমনে তন্ময় হয়ে শ্রীহরিনাম জপ করুন,-
‘’হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।‘’
জয় শ্রীরাধাকৃষ্ণের জয়। জয় শচীনন্দন গৌরহরির জয়।।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...