Friday, April 17, 2020


শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন
বিশেষ পোষ্ট
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।''

আজানুলম্বিত - ভুজৌ কনকাবদাতৌ,
সংকীর্ত্তনৈকপিতরৌ কমলায়তাক্ষৌ।
বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্ম্মপালৌ,
বন্দে জগৎপ্রিয়করৌ করুণাবতারৌ। 

শ্রীভগবানের নাম, লীলা গুণ গান করাই হলোকীর্ত্তন অর্থাৎ সুর, লয় তাল দিয়ে ভগবানের নাম - গুণগান করাই হলোকীর্ত্তন আর এইকীর্ত্তনযখন বহুলোক একত্রিত হয়ে উচ্চ স্বরে করে থাকেন, তখন তাকে বলা হয় সংকীর্ত্তন। বৈষ্ণবগণের মতে কলিযুগে শ্রেষ্ঠ ধর্মই হচ্ছেএই শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন আজকাল বহুস্থানেই শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন হচ্ছে এবং হতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও অষ্টপ্রহর, ষোলপ্রহর, চব্বিশপ্রহর, চৌষটি প্রহর প্রভৃতি সময় ধরে শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন করা হয়ে থাকে। আজকাল আমরা এই সমস্ত শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন দেখি বিভিন্ন রাগ-রাগিনী, বিভিন্ন তাল ছন্দে করা হয়ে থাকে। ইহার মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন সুরের ব্যঞ্জনায় মনকে ভগবানের পাদপদ্মে নিবিষ্ট করা।

শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ প্রভু এই নাম সংকীর্ত্তনের মাধ্যমে ভজনের পথ সুগম করেছিলেন। তাঁরাই এই নামের মাধ্যমে ভক্তি জগতে এক নব ভাবগঙ্গা এনেছিলেন। কলিকালে নাম সংকীর্ত্তনের  জনক এই দুইজনকেই বলা হয়। কলিকালে এই হরিনাম সংকীর্ত্তন করলে যাগ - যজ্ঞ ইত্যাদির ফল লাভ করা যায়। নাম সংকীর্ত্তনের মাধ্যমেই ভক্তের হৃদয়ে প্রেমের ভাব উদয় হয়। ভগবানের প্রতি মনের আকুলতার উদয় হলে আপন হৃদয়ে যে স্বার্থশূন্য বিমল ভাবের উদয় হয় তাই হলোরতিবাভক্তি আর ভগবানের প্রতি এই রতি গাঢ় হলেই তাকে বলা হয়প্রেম যাঁরা প্রকৃত ভক্ত তাঁরা কামনা করেন না। কারণ, কামনাও এক প্রকারের স্বার্থপরতা। তাঁদের মতে ভগবানই একমাত্র কাম্য বস্তু। তাঁরা ভগবান ব্যতীত আর কিছুই চান না। এই ভগবানকে লাভ করতে হলে চাই আপন চিত্ত শুদ্ধি। ভগবান ভজনেই চিত্তশুদ্ধি হয়ে থাকে। চিত্তশুদ্ধি ব্যতীত কখনও ভগবৎ দর্শন হয় না। নাম সংকীর্ত্তনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আপন চিত্তশুদ্ধি।

ভগবানের নাম চিন্তা করা, তাঁর নাম গুণগান করা, ইহাই নাম সংকীর্ত্তনের মূল উদ্দেশ্য লক্ষ্য। এক কথায় ভগবৎ সেবাই হলো নাম সংকীর্ত্তনের চরম পরম লক্ষ্য। আজ আমাদের সমাজের সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে এই নাম সংকীর্ত্তনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এই কীর্ত্তনে জাতি, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই এই কীর্ত্তনে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। এই নাম সংকীর্ত্তনের মধ্যে সাম্যতার একটি অপূর্ব রূপ ভাব পরিলক্ষিত হয়। সমাজের সকল শ্রেণীর লোক  একত্রে অংশ গ্রহণ করে আনন্দ লাভ করে শ্রীভগবানকে ভজনা করে থাকেন। এই সাম্যতার ভাব সকলকেই বড় আনন্দ দান করে এবং এই নাম সংকীর্ত্তনের মাধ্যমে সাধন - ভজন করে কলির জীব অতি সহজে মুক্তি পেতে পারে। তাই শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে,---

‘’হর্ষে প্রভু কহে শুন রামরায়।
নাম কীর্ত্তন কেলৌ পরম উপায়।।
সংকীর্ত্তন - যজ্ঞে করে কৃষ্ণ - আরাধন।
সেই সুমেধা পায় কৃষ্ণের চরণ।।
নামসংকীর্ত্তন হৈতে সর্ব্বানর্থনাশ।
সর্ব্বশুভোদয় কৃষ্ণপ্রেমের উল্লাস I I’’
                             ---(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত অন্তলীলা, ২০পরিচ্ছেদ৭,,)

অতি আনন্দিত হয়ে মহাপ্রভু রায় রামানন্দ স্বরূপ দামোদরকে বললেনকলিযুগে শ্রীশ্রী নাম সংকীর্ত্তনই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সাধন। কলিতে এই নাম সংকীর্ত্তনের মতো এত সহজ পথ আর নেই। ভক্তের মধ্যে ভক্তির ভাব উদয় হলেই ভক্তের মধ্যে যথারীতি এক উন্মাদনার ভাব উদয় হয়। তখন স্থান, কাল আর পাত্রের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। যেখানে সেখানেই হরির নাম নেওয়া যায়। তাই (শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে
‘’খাইতে শুইতে যথা-তথা নাম লয়।
দেশ-কাল-নিয়ম নাহি, সর্ব্বসিদ্ধি হয়।।‘’

এইভাবে যথা-তথা, যখন-তখন নাম কীর্ত্তন করতে করতে ভক্তের মধ্যে ভগবানের জন্য দিব্যভাবের উদয় হয়ে যায়। তখন ভক্ত দিব্যোন্মাদ হয়ে যান। হৃদয়ে নামের উন্মাদনা ভাব তাঁর মধ্যে উদয় হলে তিনি নামের প্রেমে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন। ইহা নাম সংকীর্ত্তনের প্রভাবেই ভক্তের হৃদয় এইভাবে উদ্বেলিত হয়। তাই এই নাম সংকীর্ত্তন আনন্দের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। যার ফলে এই কীর্ত্তন সাধককে ভক্তি বা প্রেমের রাজ্যে নীয়ে গিয়ে তাঁকে ভগবানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক অভিনব উপায়, যে উপায় যুগ যুগ ধরে আমাদের ভজনার পথকে চিরসুগম করে আসছে। এই নাম সংকীর্ত্তনের কথা বলতে গিয়ে শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীশিক্ষাষ্টকের প্রথম শ্লোকে বলেছেন,---
‘’চেতোদর্পণমার্জনং ভবমহাদাবাগ্নি-নির্বাপণং,
শ্রেয়ঃকৈরবচন্দ্রিকাবিতরণং বিদ্যাবধূজীবনম্।
আনন্দাম্বুধিবর্ধনং প্রতিপদং পূর্ণামৃতাস্বাদনং,
সর্বাত্মস্নপনং পরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণসংকীর্ত্তনম্।।‘’

অর্থাৎ,- চিত্তরূপ দর্পণের মার্জনকারী, ভবরূপ মহাদাবাগ্নি নির্বাপণকারী, জীবের মঙ্গলরূপ কৈরবচন্দ্রিকা বিতরণকারী, বিদ্যাবধূর জীবনস্বরূপ, আনন্দ - সমুদ্রের বর্ধনকারী, পদে পদে পূর্ণামৃতস্বাদনস্বরূপ এবং সর্বস্বরূপে শীতলকারী শ্রীকৃষ্ণ - সংকীর্ত্তন বিশেষরূপে জয়যুক্ত হোক।

তাই আসুন, ভক্তির সহজ পথ এই নাম সংকীর্ত্তন করে ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম লাভ করার জন্য আমরা সকলেই সচেষ্ট হই। ইহাই হোক আমাদের সকলের একান্ত প্রত্যাশা। পরমপুরুষ ভগবান আমাদের সকলের মঙ্গল করুন।

গায় গোরা মধুর স্বরে।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
গৃহে থাক, বনে থাক, সদাহরি’ ব’লে ডাক।
সুখে - দুঃখে ভুলো না’ক, বদনে হরিনাম কর রে।।
মায়াজালে বদ্ধ 'য়ে, আছ মিছে কাজ 'য়ে।
এখনও চেতন পেয়ে, ‘রাধা - মাধব’  নাম বল রে।।
জীবন হইল শেষ, না ভজিলে হৃষীকেশ।
ভক্তিবিনোদ  উপদেশ, এক বার নাম - রসে মাত রে।
গায় গোরা মধুর স্বরে…।

''সর্বে ভবন্তু সুখিন,সর্বে সন্তু নিরাময়া।
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু,মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত।।''

অর্থাৎ,- সবাই যেন সুখী হয়, সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন। সকলের শান্তি লাভ করুন।।

ওম শান্তি শান্তি শান্তি। (বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪)

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...