Thursday, April 23, 2020




"শরণাগতি"
বিশেষ পোষ্ট
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

গুরবে গৌরচন্দ্রায় রাধিকায়ৈ তদালয়ে।
কৃষ্ণায় কৃষ্ণভক্তায় তদ্ভক্তায় নমো নমঃ।।

পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে বদ্ধজীবের সম্বন্ধ পুনঃস্থাপনের অন্যতম পন্থা হলো শ্রীভগবানের  শ্রীচরণে পূর্ণ শরণাগতি

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম চরমশিক্ষা - "শরণাগতি" শ্ৰীরূপ গোস্বামিভক্তি রসামৃত সিন্ধুতে শরণাগতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। ঠাকুর ভক্তিবিনোদ তাঁর আদর্শ-চরিত্রে শিক্ষায়, শরণাগতি সম্বন্ধে বিভিন্ন প্ৰবন্ধে তাঁর স্বরচিত গীতি-গ্রন্থে শরণাগতির ষড়বিধ লক্ষণের অভূতপূৰ্ব বিশ্লেষণ করেছেন। শ্ৰীজীব গোস্বামি প্ৰভু ভক্তিসন্দর্ভে শ্ৰীভক্তি রসামৃত সিন্ধুতে কথিত শরণাগতির ছয়টি লক্ষণের মধ্যেকৃষ্ণকে গোপ্তৃত্বে বরণ শরণাগতির ‘‘অঙ্গী অন্যান্য পাঁচটিকেঅঙ্গবলেছেন।

যাঁরা কৃষ্ণকে একমাত্র পালয়িতা বলে বরণ করেননি বা সেই বিষয়ে যাঁদের কিঞ্চিৎ মাত্ৰও সন্দেহ আছে, তাঁরা পূর্ণ শরণাগত নন। সেই অদ্বিতীয় গোপ্তা কৃষ্ণের গোপীগণ পূর্ণশরণাগত। ঠাকুর ভক্তিবিনোদ তাঁরশরণাগতি' গীতির প্রারম্ভে বলেছেন,

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য   প্রভু   জীবে   দয়া   করি।
স্বপার্ষদ   স্বীয়   ধাম   সহ   অবতরি।।

অত্যন্ত  দুর্ল্লভ  প্রেম  করিবারে  দান।
শিখায়   শরণাগতি   ভকতের   প্রাণ।।

দৈন্য,  আত্মনিবেদন,  গোপ্তৃত্বে বরণ।
'অবশ্য রক্ষিবে   কৃষ্ণ'  - বিশ্বাস পালন।।

ভক্তিঅনুকূল   মাত্র   কার্য্যের   শ্বীকার।
ভক্তিপ্রতিকূল -  ভাব   বর্জ্জন - অঙ্গীকার।।

ষড়ঙ্গ   শরণাগতি   হইবে   যাঁহার।
তাঁহার   প্রার্থনা   শুনে   শ্রীনন্দকুমার।।

রূপ - সনাতন - পদে   দন্তে   তৃণ   করি'
ভকতিবিনোদ   পড়ে   দুই   পদ   ধরি'।।

কাঁদিয়া   কাঁদিয়া   বলে,  আমি   '   অধম।
শিখায়ে   শরণাগতি       করহে   উত্তম।।

শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য  প্রভু জীবের প্রতি দয়াবিশিষ্ট হয়ে অত্যন্ত দুর্লভ প্রেম দান করবার জন্য নিজ-পাৰ্ষদ নিজ-ধাম সহ অবতীর্ণ হয়ে ভক্তগণের জীবনস্বরূপ শরণাগতি শিক্ষা দিয়েছেন।

ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলছেন,
‘’ষড়ঙ্গ শরণাগতি হইবে যাহার।
তাহার প্রার্থনা শুনে শ্ৰীনন্দকুমার।।''

‘’ষড়ঙ্গ শরণাগতি'' কি ???
''আনুকূল্যস্য সংকল্পঃ    প্রতিকূল্য বিবর্জ্জনম। 
রক্ষিষ্যতীতিবিশ্বাসো     গোপ্তৃত্বে বরণং তথা।
আত্মনিক্ষেপ    কার্পণ্যে    ষড়বিধা    শরণাগতিঃ।।'' (বৈষ্ণব তন্ত্র -বাক্য)

‘’শরণাগতির ছয় প্রকার লক্ষণ,- ০১. কৃষ্ণভক্তির অনুকূল যা গ্রহণ করা, ০২. কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল বিষয় বর্জ্জন করা, ০৩. কৃষ্ণ সবসময়ই রক্ষা করবেন এই বিশ্বাস, ০৪. শ্রীকৃষ্ণকে প্রভুরূপে গ্রহণ করা, ০৫. সর্বতোভাবে শরণাগত হওয়া এবং ০৬. দৈন্য।‘’  (হরিভক্তিবিলাস, ১১/৪১৭)  
শরণাগতির এই ছয় প্রকার ভেদ। একেই ‘’ষড়ঙ্গ শরণাগতি’’ বলে। আমরা ভগবানকে তাঁর নামের দ্বারা যে আহ্বান করি, সেই ডাক শরণাগত ব্যক্তির নিকটেই ফলদায়ক হয়। শরণাগতি ব্যতীত ভগবান কারও আহ্বানে সাড়া দেন না।

শ্রীকৃষ্ণকে প্রভুরুপে বরণের বিশেষ প্রাপ্তি::--
যিনি শ্রীকৃষ্ণকে প্রভুরুপে গ্রহণ করেন , তাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণ বিশেষভাবে যত্নপরায়ন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন,-
''অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।''   গীতা (/২২)
অর্থাৎ,- অনন্যচিত্তে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে, পরিপূর্ণ ভক্তি সহকারে যাঁরা সর্বদাই আমার উপাসনা করেন, সেই শরণাগত ভক্তের সমস্ত অপ্রাপ্য বস্তু আমি বহন করি এবং তাঁদের প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ করি। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণকে লক্ষ্য করে বলেছেন -- আমি নিত্য দাস তুমি পালয়িতা, তুমি গোপ্তা জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণের এক নাম জগন্নাথ অর্থাৎ তিনিই জগতের নাথ বা প্রভু

‘’ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি।।‘’  গীতা (/৩১)
অর্থাৎ,- তিনি শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হন এবং নিত্য শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়! তুমি দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হন না।হে ভগবান, যেহেতু আপনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, যিনি আপনার কাছে সুরক্ষা প্রার্থনা করেন, আপনি তাঁকে রক্ষা করেন। তাই আমরা আপনাদের কাছে আমাদের সুরক্ষা প্রার্থনা করি।

শ্রীমন্মহাপ্রভুর উক্তি,-
"হরির চরণে শরণ যে লয়।
সেহ মোর, মুই তাঁর জানিহ নিশ্চয়।।"   (চৈঃ ভাঃ)

"চরণে শরণ যদি লয় কোন পাকে।
আপনাকে দিয়া হরি বশ হইয়া থাকে।।"
শ্রীজীব গোস্বামীপাদ বলেছেন,-
 "শরণাগতস্য অভয়ং অশরণাগতস্য ভয়ং ভবতি।"

"কর্মণা মনসা বাচা যেহচ্যুতং শরণং গতাঃ।
সমর্থো যমস্তেষাং তে মুক্তিফলভাগিনঃ।।"
যাঁরা কায়মনোবাক্যে শ্রীহরিকে আশ্রয় করে, যম তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন না। পরন্তু তাঁরা ভগবৎ কৃপায় যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বৈকুন্ঠধাম লাভ করে
"তেষাং সমর্থঃ জাতেহপি পাপে কিঞ্চিৎ কর্ত্তুং শক্নুয়াৎ।
যতো মুক্তে ফলং ভক্তি শ্রীবৈকুন্ঠলোকপাপ্তির্বা তদ্ভাগিনঃ।। হরিভক্তিবিলাসঃ

"চারি বর্ণাশ্রমী যদি কৃষ্ণ নাহি ভজে।
স্বধর্ম করিলেও নরকে পড়ি মজে।।" (চৈঃ চঃ )

বৃন্দাবনদাস ঠাকুর বলেছেন,-
"জগতের পিতা কৃষ্ণ, যে না ভজে বাপ।
পিতৃদ্রোহী পাতকের জন্ম জন্ম তাপ।।"

‘’সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।‘’  গীতা (১৮/৬৬)
অর্থাৎ,- সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। এখানে সর্বধর্ম ত্যাগ বলতে একমাত্র কৃষ্ণাশ্রয় ব্যতীত পৃথিবীতে যাবতীয় ধর্ম-কর্ম আছে তাহা ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে ভগবান্ তাই বলেছেন,- হে জীবগণ, তোমরা সবকিছু মায়ামোহ ধর্মাধর্ম কর্মাকর্ম ছেড়ে কেবলমাত্র  আমারই শরণ নাও , তাহলে আমি  তোমাদেরকে  সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না। পুনঃ বলেছেন,-
"দৈবীহ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দূরত্যয়া
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তীতে ।।" গীতা ।।
মায়াকে জয়করা দুর্বলচেতা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যদি শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে শরণাগতি আসে তবেই এই মায়াকে আমরা অতিক্রম করতে পারি।
"সাধূ শাস্ত্র কৃপায় যদি কৃষ্ণোন্মুখ হয়।
সেই জীব নিস্তরে মায়া তাহারে ছাড়য় ।।"  (চৈঃ চঃ)
পুনঃ বলেছেন,-
" প্রাপ্যপি দুর্ল্লভতরং মানুষং বিবুধেস্পিতং
যৈরাশ্রিতো গোবিন্দস্তৈরাত্মা বঞ্চিতশ্চিরম্ ।।"  ( ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ )
দেব দুর্লভ মনুষ্য জন্ম পেয়ে যাঁরা শ্রীগোবিন্দের শ্রীপাদপদ্মে শরণ না নেয় তাঁরা আজীবন বিবিধ দুঃখ ভোগ করে থাকে
শ্রীসনাতন গোস্বামীপাদ বলেছেন,-
"শরণাগত তত্ত্বে কেবলং ভগবদীয়োহহং এভাবন্মাত্রম্।"
হে ভগবান, আমি তোমার একমাত্র শরণাগত, এইটুকু বললেই যথেষ্ট
"কৃষ্ণ তোমার হঙ্ যদি বলে একবার
মায়াবন্ধ হৈতে কৃষ্ণ তারে করেন পার।।"
হে ভগবান, আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম, সম্পূর্ণ ষোলআনা মন দিয়ে এই কথা বলে যে ব্যক্তি আমার আশ্রয় গ্রহণ করে আমি তাকে এই দুঃখময় সংসার সাগর থেকে অচিরেই উদ্ধার করে থাকি।

পূর্ণ শরণাগত ভক্ত একটি শিশুর মতো। শিশুটি যেমন তার মাকে ছেড়ে যেতে পারে না, তাতে তার মা তার উপর রাগ করুক আর স্নেহ করুক যাই করুক না কেন? তাই পূর্ণ নির্ভরশীল-সম্পন্ন ভক্তের মনোভাব এইভাবে বর্ণিত হয়েছে, “কৃষ্ণের ইচ্ছা যা আমি কেবল তাই করব এবং আমি আমার নিজ ইচ্ছানুসারে কিছু চিন্তা করব না।

যদিও ভগবানের দ্বারা সমস্ত সৃষ্টি পালিত হচ্ছে, তবুও বদ্ধজীব ভগবানের ভগবত্তা বুঝতে না পেরে তাঁর শরণাগত হয় না। কিন্তু আমাদের সকলের উচিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই পালনকর্ত্তা বা প্রভুরুপে বরণ করা এবং সর্বতোভাবে তাঁর শ্রীচরণে একনিষ্টভাবে শরণাগত হওয়া।

আসুন আমরা বিষয়চিন্তা বাদ দিয়ে হরি নাম নিষ্ঠা সহকারে জপ কীর্ত্তন করি।
হরে"কৃষ্ণ"হরে"কৃষ্ণ"কৃষ্ণ"কৃষ্ণ"হরে"হরে I
হরে"রাম"হরে"রাম"রাম"রাম"হরে"হরে।।
জয় শ্রীরাধাকৃষ্ণের জয়। জয় শচীনন্দন গৌরহরির জয়।।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...