Tuesday, April 14, 2020


তুলসী মাহাত্ম্য
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

বৃন্দাবন - স্থিরচরান পরিপালয়িত্রী !
বৃন্দে ! তয়োরসিকয়োরতি - সৌভগেন।।
আঢয়াসি তৎকুরু কৃপা গণনা যথৈব।
শ্রীরাধিকা - পরিজনেষু মমাপি সিদ্ধয়েত।। (শ্রী সংকল্প - কল্পদ্রুম)
তুলসী মাহাত্ম্য-বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন পূজনীয়া?
মন্দির প্রাঙ্গণে গৃহাঙ্গনে পবিত্র তুলসী বৃক্ষ রাখা, তাঁর পূজা -পরিক্রমা করা, কন্ঠে তুলসীকাষ্ঠের মালা ধারণ করা হিন্দুদের বিশেষত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রাচীন সংস্কৃতি। কিন্তু কেন বৃক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তুলসীকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়, বিষয়টি অনেকেরই অজানা। তাই এই প্রবন্ধে তুলসীর কী পরিচয়? ভূমণ্ডলে তুলসীর আবির্ভাব কীভাবে হলো? তুলসী পূজা কেন করবেন? তার শাস্ত্র প্রমাণ! ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

তুলসীর পরিচয়/তুলসী মূলত কে?
সাধারণ বিচারে তুলসী (Tulsi/Holy/Basil/ thai Krapho) একটি  Lamiaceae পরিবারের অন্তর্গত এক সুগন্ধি ঔষধি উদ্ভিদ। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম Ocimum sanctum ( sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) কল্প কল্প ধরে প্রায় প্রতিটি হিন্দু গৃহে পবিত্র বৃক্ষরূপে পূজিতা হয়ে আসছে। মূলত, তুলসী হলেন লক্ষীদেবীর তথা শ্রীমতি রাধারাণীর অংশস্বরূপা সখী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী। গোলোক বৃন্দাবনে (চিন্ময়জগতে) গোপিকা বৃন্দাদেবীরূপে তুলসী রাধাকৃষ্ণের নিত্য সেবিকা এবং তাদের বিচিত্র দিব্য লীলা সম্পাদনের মূল পরিচালিকা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের দূতী, কুঞ্জাদি সংস্কারে অভিজ্ঞা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পণ্ডিতা। তিনি সমস্ত দেবীগণের মধ্যে পবিত্ররূপা এবং সমুদয় বিশ্বের মধ্যে তাঁর তুলনা নেই বলে তিনি তুলসী নামে কীর্ত্তিতা (ব্র।বৈ।পু। প্রকৃতিখন্ড, ২২।২৪, ৪২)

কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী বলে তাকে ভক্তিদেবী বা ভক্তিজননী বলেও সম্বোধন করা হয়। বৃন্দাদেবীর আজ্ঞাক্রমেই বৃন্দাবনে পত্র, পুষ্প, ফল, ভ্রমর, মৃগ, ময়ূর, শুক - শারী ইত্যাদি পশুপাখিরাও চিরবসন্ত শ্রীকৃষ্ণের কেলিকুঞ্জে পরম রমণীয় শোভা ধারণ করে। সৃষ্টির প্রারম্ভে স্বায়ম্ভূব মন্বন্তরের প্রথম পাদে তিনি কেদার রাজার কন্যারূপে বৃন্দাদেবী নামে যজ্ঞকুণ্ড থেকে আবির্ভূত হন। তিনি যে বনে তপস্যা করেছিলেন সেই বন জগতে বৃন্দাবন নামে প্রসিদ্ধ হয়। শ্রীল কবিকর্ণপুর গোস্বামীকৃতগৌরগণোদ্দেশ দীপিকাঅনুসারে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যলীলায় বৃন্দাদেবী ''মুকুন্দ দাস'' রূপে আবির্ভূত হন।
‘’এই বৃন্দাদেবী এবে কৈল আগমন।
শ্রীমুকুন্দ দাস নামে দিল দরশন।‘’(ভক্তামৃত লহরী)

আবার, এই বৃন্দাদেবীই অন্য এক স্বরূপে অভিরামশক্তি শ্রীমতি মালিনীদেবী রূপে আবির্ভূত হন।‘’ ব্রজে বৃন্দা সমজ্ঞাতা ইদানিং মালিনী স্মৃতা।।‘’ (শ্রীঅভিরাম লীলামৃত, ৭ম পরিচ্ছেদ) গৌড়ীয় আচার্যশ্রেষ্ঠ শ্রীল রূপ গৌস্বামীপাদশ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণগণোদ্দেশ দীপিকাগ্রন্থে বৃন্দাদেবীর পরিচয় প্রসঙ্গে লিখেছেন,- “শ্রীমতি বৃন্দাদেবীর দেহকান্তি মনোহর তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়; নীল বসন পরিধানে মুক্ত পুষ্প দ্বারা বিভূষিতা। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রভানু, মাতা ফুল্লরা, পতির নাম মহীপাল ভগিনী মঞ্জরী। শ্রীমতি বৃন্দাদেবী বৃন্দাবনে সর্বদাই বাস করেন। শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের নানাবিধ লীলার দূতী এবং লীলারসে সর্বদাই সমুৎস্যুক, উভয়ের মিলনকার্যে প্রেমে পরিপূর্ণা থাকেন এই বৃন্দাদেবী। ‘’বৃন্দাদেবীর প্রতি অনুগত্য তাঁর কৃপা ভিন্ন বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের নিত্যসেবাধিকার কদাপি কারো পক্ষে সম্ভব নয়।‘’  তাই, বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের নিকট তুলসী পরম আদরণীয়া, শ্রদ্ধার্ঘ্য পূজনীয়া।

ভূমণ্ডলে তুলসীর আবির্ভাব কীভাবে হলো?
রাধাকৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া সেবিকা তুলসী মহারাণী তথা বৃন্দাদেবী জগজ্জীবের কল্যাণার্থে ভিন্ন ভিন্ন কল্পে মন্বন্তরে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এজগতে আবির্ভূত হন। তাই জগতে তুলসীর আবির্ভাব সম্পর্কে পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। একই তুলসীদেবী কখনো জলদ্ধরের পত্নী, কখনো শঙ্খচূড়ের পত্নী, আবার কখনো বা ধর্মদেবের পত্নী, কখনো ধর্মধ্বজ কন্যা, কখনো চন্দ্রভানু কন্যা, আবার কখনো কেদাররাজের কন্যারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে, এই প্রত্যেক কন্যাই এক বৃন্দাদেবী এবং প্রত্যেক জন্মেই তিনি কৃষ্ণভক্তিপরায়ণা ছিলেন। প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে বৃন্দাদেবীর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়। তাই প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক বর্ণনা প্রবন্ধে তুলে ধরা হলো।

 ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড, ৮৬ অধ্যায়) উল্লেখ আছে যে, শ্রীকৃষ্ণের পিতা নন্দমহারাজের প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, হে ব্রজরাজ, সৃষ্টির প্রারম্ভে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরের প্রথম পাদে স্বয়ম্ভুব মনু শতরূপার দুইপুত্র হয় প্রিয়ব্রত উত্তানপাদ। উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব। ধ্রুব মহারাজের পুত্র নন্দসাবর্ণি, তাঁর পুত্র কেদার রাজ। তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি। একসময় কেদার রাজার যজ্ঞকুণ্ড থেকে লক্ষীদেবীর অংশরূপে এক কন্যা আবির্ভূত হন (কমলা কলয়া জাতা যঞ্জকুণ্ড সমুদ্ভবা। বহ্নিশুদ্ধাং শকধানা রত্নভূষণ ভূষিতাস) এবং সে কন্যা কেদার রাজ তাঁর পত্নীকে তাঁর পিতামাতা রূপে গ্রহণ করেন। পিতামাতাকে অবগত করে সেই কন্যা তপস্যার উদ্দেশ্যে যমুনার তীরবর্তী রমণীয় পূণ্য বনে গমন করেন। কেদারকন্যার নাম ছিল বৃন্দা। তাই, তার তপোবন বলে সেই বন জগতে বৃন্দাবন নামে প্রসিদ্ধ হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার মানসে দীর্ঘকাল তপস্যার পর ব্রহ্মার নিকট থেকে তিনি শীঘ্রই শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার বর প্রাপ্ত হন। এরপর বৃন্দাকে পরীক্ষা করার জন্য ব্রহ্মা মনোহর বেশে ধর্মকে তাঁর নিকট প্রেরণ করেন। কন্দর্পসম সুপুরুষ ধর্মকে বৃন্দা প্রণাম সেবাদি করেন এবং তাঁর  নিকটেও একই বর প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণপ্রাপ্তি সুদুর্লভ বলে ধর্ম বৃন্দাকে নিরুৎসাহিত করে তাঁকেই (ধর্মকেই) পতিরূপে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। বৃন্দা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনবারতোমার ক্ষয় হোকবলে ধর্মকে অভিশম্পাত করেন।

এরপর সূর্যদেবের নির্দেশে বৃন্দা পুনঃঅভিশাপ প্রদানে নিরত হন এবং সমস্ত দেবতা বৃন্দাকে ধর্মের পুনঃজীবন দান করার নির্দেশ দেন। ধর্মপত্নী মুর্তিদেবীও তখন সেখানে উপস্থিত হন। তার অনুরোধে ভগবান শ্রীবিষ্ণু বৃন্দাদেবীকে বলেন, “হে বৃন্দে, তুমি তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মার ন্যায় যে আয়ু লাভ করেছ তা এখন ধর্মকে অর্পণ করে গোলোকধামে গমন করো। তোমার এই তপস্যার দ্বারা তুমি পরে আমাকে অবশ্যই লাভ করবে। বরাহ কল্পে তুমি গোলোক হইতে গোকুলে (ভৌম বৃন্দাবনে) এসে জন্মলাভ করবে। রাসমণ্ডলে রাধিকা গোপীগণের সাথে আমাকে প্রাপ্ত হবে।‘’ বিষ্ণুনির্দেশে বৃন্দাদেবীর কৃপায় ধর্ম পুনরুত্থিত হলেন। ততক্ষণে গোলোক হতে এক দিব্য রথ এল বৃন্দাদেবী তাঁর নিত্য ধাম প্রাপ্ত হলেন এবং অন্যান্য দেবতারা স্ব-স্ব স্থানে প্রস্থান করলেন।

তুলসী পূজা কেন করবেন? তার শাস্ত্র প্রমাণ!
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ-  ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (প্রকৃতিখণ্ড, ২২ অধ্যায়) অনুসারে, একসময় দেবী তুলসী অভিমান বশত অন্তর্হিত হলে তুলসীবনে গমনপূর্বক শ্রীহরি তুলসীর পূজা স্তব করেন। তখন দেবী তুলসী বৃক্ষ হইতে আবির্ভূতা হন এবং শ্রীহরির পাদপদ্মে শরণ নেন। সেখানে আরও বলা হয়েছে, যে মানব হরিপ্রণীত মন্ত্ররাজ পাঠ করত ঘৃতপ্রদীপ, ধূপ, সিঁদুর, চন্দন, পুষ্প, নৈবেদ্য অন্যান্য উপহার দ্বারা যথাবিধি তুলসীর পূজা করবেন, তিনি সর্বসিদ্ধি লাভ করবেন।

পদ্মপুরাণঃ- পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে (অধ্যায় ২৩) মহাদেব নারদমুনিকে সম্বোধন করে বলেন-তুলসী সম্বন্ধীয় পত্র, পুষ্প, ফল, মূল, শাখা, ত্বক, স্কন্ধ এবং মৃত্তিকাদি সমস্তই পবিত্র। যে গৃহে তুলসী - বৃক্ষ অবস্থিত, তার দর্শন - স্পর্শনেই ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিলয়প্রাপ্ত হয়। যে গৃহে, গ্রামে বা বনে তুলসী বৃক্ষ বিরাজ করে, জগৎপতি শ্রীহরি প্রীতচিত্তে সেই সেই ক্ষেত্রে বাস করেন। পদ্মপুরাণ,সৃষ্টিখণ্ডে (অধ্যায়-৬০) সমস্ত পত্র পুষ্প মধ্যে মঙ্গলময়ী তুলসীই সাধুতমা। তা সর্বমঙ্গলপ্রদা, শুদ্ধা, বৈষ্ণবী, বিষ্ণুপ্রিয়া, ভক্তিমুক্তিপ্রদা, মুখ্যা এবং সর্বলোক মধ্যে পরম শুভা। যেখানেই তুলসী বন, সেখানেই ভগবান কেশব (কৃষ্ণ) এবং সেখানেই ব্রহ্মা, কমলা (লক্ষী) অন্য সমস্ত দেব সন্নিহিত। অতএব, তুলসী দেবীকে সর্বদাই পূজা করবে।  পদ্মপুরাণ, সৃষ্টিখণ্ডে (অধ্যায়- ৬১।৫-) তুলসী নামোচ্চারণমাত্রই মুরারি হরি প্রীতি লাভ করেন, পাপসকল বিলয় প্রাপ্ত হয় এবং অক্ষয় পূণ্য লাভ হয়ে থাকে।এমন তুলসীকে  লোকে কেন পূজা - বন্দনা করবে না?

''নিত্যং যস্তুলসী দত্ত্বা পূজয়েন্মাঞ্চ মানবঃ।
লক্ষাশ্বমেধজং পুণ্যং লভতে নাত্র সংশয়ঃ।।''(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড ২১।৪৫)

অর্থাৎ,- “যে মানব প্রত্যহ তুলসীপত্র দ্বারা আমাকে পূজা করবেন, নিশ্চয়ই তার লক্ষ অশ্বমেধ  যজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হবে।‘’ এভাবে শাস্ত্রে তুলসীপূজার বহু মাহাত্ম্য কীর্ত্তিত হয়েছে। নামাচার্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর সর্বদা তুলসীকে সামনে রেখে হরিনাম জপ করতেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, নামাচার্য হরিদাস ঠাকুর, শিব - পার্বতী, এমনকি শ্রীমতি রাধারাণী তুলসী সেবা আচরণের মাধ্যমে জীবকে তা অনুসরণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং, কৃষ্ণভক্তি লাভেচ্ছু প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত নিয়মিত তুলসীদেবীর আরাধনা করা।

জয় বৃন্দে। জয় তুলসী মহারাণী। জয় বৃন্দাবন ধাম।।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...